যে ইহুদি রাসুলকে (সা:) ঋণ দিয়েছিলেন

যে ইহুদি রাসুলকে (সা:) ঋণ দিয়েছিলেন

একজন সাহাবীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ইহুদির কাছ থেকে ঋণ নেন। ঋণ গ্রহণের সময় বিধান হলো ঋণ ফেরতের তারিখ নির্ধারণ করা। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইহুদিকে একটি তারিখ বলেন, যে তারিখে তিনি ঋণ ফেরত দিবেন।

একদিন নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে নিয়ে একটি জানাযা থেকে ফিরছেন। তাঁর সাথে ছিলেন আবু বকর, উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) মতো মহান সাহাবী। ঠিক সেই সময় ঐ ইহুদি লোকটি নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গলার চাদরে ধরে রাগতস্বরে, অভদ্র ভাষায় বললো-
“ও মুহাম্মদ! আমার কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছিলে, সেই অর্থ কোথায়? আমি তো তোমার পরিবারকে চিনি। ঋণ নিলে তোমাদের আর কোনো খবর থাকে না!”

নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর কথায় সাহাবীরা নিজেদের জীবন দিয়ে দিতে পারেন। তিনি যদি সাহাবীদেরকে একটু ইশারা দেন, তাহলে সাহাবীরা তার (ইহুদি) গর্দান উড়িয়ে ফেলবেন। তাঁকে সবার সামনে এতো বড়ো অপমান করা হলো? অথচ ঋণ পরিশোধের যে তারিখ ধার্য করা হয়েছিলো, সেটা এখনো বাকি আছে। সময়ের আগেই সুন্দরভাবে না চেয়ে এভাবে অভদ্র ভাষায় দাবি করতে হবে?

উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সহ্য করতে পারলেন না। তিনি তাঁর স্বভাবজাত সেই বিখ্যাত উক্তিটি বললেন-
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি অনুমতি দিন, তার গলা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলি?”
নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক্ষেত্রে যেমন ক্ষমতা ছিলো, তেমনি তিনি ন্যায় ছিলেন (কারণ, ঋণ পরিশোধের সময়ের পূর্বেই ইহুদি লোকটি তাঁর চাদর ধরে অপমান করেছে)। ইহুদির অমার্জিত আচরণকে তিনি শাস্তি দিতে পারেন। ইহুদিরা তাঁকে নবী বলে স্বীকৃতি না দিক, তারা তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান, চিফ জাস্টিস হিশেবে তো স্বীকৃতি দেয় (মদীনা সনদের আলোকে)। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইহুদিকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেবার অধিকার রাখেন।

কিন্তু, তিনি উল্টো উমর ইবনুল খাত্তাবকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন:
“উমর, তোমার কাছ থেকে তো উত্তম ব্যবহার আশা করা যায়। তুমি এভাবে না বলে বরং আমাকে বলতে পারতে- ‘আপনি তাঁর ঋণ পরিশোধ করুন’। কিংবা তাকে বলতে পারতে- আপনি সুন্দরভাবে ঋণের কথা বলতে পারতেন।”
অসুন্দরের জবাব সুন্দর দ্বারা, অনুত্তমের জবাব কিভাবে উত্তম দ্বারা দিতে হয় সেটা নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সহ সাথে উপস্থিত সাহাবীদেরকে শেখালেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমরকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নির্দেশ দিলেন-
“উমর, যাও তার সাথে এবং তাকে তার ঋণ পরিশোধের পর আরো বিশ সা’ (৩২ কেজি) খেজুর দিও। কারণ, তুমি তাকে ভয় দেখিয়েছো।”

উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইহুদিকে সাথে নিয়ে গেলেন। তাকে তার প্রাপ্য ঋণ প্রদান করলেন এবং সাথে আরো ৩২ কেজির মতো খেজুর দিলেন। ইহুদি তো অবাক! সে একে তো সময়ের আগেই পাওনা দাবি করেছে, তার উপর সবার সামনে নবিজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অপমান করেছে; তবুও নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে পাওনা দিয়ে দিলেন, সাথে দিচ্ছেন আরো ৩২ কেজি খেজুর!?

সে জিজ্ঞেস করলো, “অতিরিক্ত এগুলো কেনো?”
উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, “কারণ, আমি তোমাকে হুমকি দিয়েছি। সেটার কাফফারা হিশেবে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এগুলো দিতে বললেন।”
এটা শুনে ইহুদি বললো, “উমর, তুমি কি জানো আমি কে?”
উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, “না, আমি জানি না। তুমি কে?”

ইহুদি বললো, “আমি যায়িদ ইবনে সু’নাহ।”
তার নাম শুনে উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) চক্ষু চড়কগাছ! যায়িদ ইবনে সু’নাহ? মদীনার সেই বিখ্যাত ইহুদি রাবাই (ইহুদিদের আলেম)? উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তার নাম জানতেন, কিন্তু তিনিই যে ঐ ব্যক্তি, সেটা তিনি জানতেন না।
যায়িদ ইবনে সু’নাহ বললেন, “হ্যাঁ, আমিই সেই ইহুদি রাবাই। আমাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হবার প্রমাণের যতো ভবিষ্যৎবাণী পাওয়া যায়, সবগুলোই আমি তাঁর মধ্যে পেয়েছি। শুধু দুটো বিষয় পরীক্ষা করা বাকি ছিলো।”

সেই দুটো ছিলো:
তাঁকে কেউ রাগালে তিনি সহনশীলতা দেখাবেন।
কোনো মূর্খ তাঁর কাছে এসে মূর্খের মতো আচরণ করলে তিনি বরং সেই মূর্খের সাথে ভালো আচরণ করবেন। অর্থাৎ তিনি মন্দের জবাব ভালোর মাধ্যমে দিবেন, অনুত্তমের জবাব উত্তমের মাধ্যমে।

যায়িদ ইবনে সু’নাহ নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধ্যে সেই দুটো গুণও এবার দেখতে পান। তিনি নবিজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগানো সত্ত্বেও নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাথে রাগ করেননি; উল্টো তার পাওনা অর্থের বেশি তাকে দিয়েছেন।
এবার যায়িদ ইবনে সু’নাহ বললেন:
“ও উমর, তুমি সাক্ষী থাকো- আমি আল্লাহকে আমার রব হিশেবে, ইসলামকে আমার ধর্ম হিশেবে এবং মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার নবী হিশেবে মেনে নিলাম। আমার অনেক সম্পদ আছে। আমি আমার অর্ধেক সম্পদ ইসলামের তরে দান করে দিলাম।”

তথ্যসূত্র:
সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৮৮, আল-বায়হাকী: ১১০৬৬, মুস্তাদারক হাকিম: ৬৫৪৭। ইমাম হাকিম (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url